Wellcome to National Portal
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ২৩rd জুন ২০১৫

কচ্ছপ প্রজনন ও চাষ ব্যবস্থাপনা

কচ্ছপ প্রজনন ও চাষ ব্যবস্থাপনা

 

পটভূমি

কচ্ছপ মাংসাশী ও তৃণভোজী উভচর জাতীয় প্রাণী। মানুষের খাদ্য হিসাবে কচ্ছপের ব্যবহার দিন দিন বাড়তে থাকায় অতিরিক্ত আহরণ ও পরিবেশের বিপর্যয়ের দরুন বাংলাদেশে কচ্ছপের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। তাছাড়াও কচ্ছপ রপ্তানী পণ্য বিধায় প্রতি বছর এর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। কচ্ছপের বাসস্থানের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা ও ভারসাম্যপূর্ণ আহরণ নিশ্চিত করতে না পারলে শীঘ্রই এদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে পড়বে।

কচ্ছপের প্রজাতিসমূহ

পৃথিবীতে কচ্ছপের ৩৪০টি প্রজাতি রয়েছে যাদের ভৌগোলিক বিস্তৃতি অত্যন্ত ব্যাপক। বাংলাদেশে প্রায় ২৫ প্রজাতির কচ্ছপ রয়েছে। তবে এদের মধ্যে ১১টি প্রজাতি মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয় যার ৪ টি বিদেশে রপ্তানী করা যায়। বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজতিগুলো নিম্নে প্রদত্ত হলো (সারনি ২):

সারনি ২: বাংলাদেশে অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন কচ্ছপের প্রজাতি

ক্রম 

ইংরেজী নাম

বৈজ্ঞানিক নাম    

আঞ্চলিক নাম

০১

রুফড টার্টল

(Roofed turtle)

কাচুগা টেনটোরিয়া

(Kachuga tentoria)

মাজহারি কাইট্টা

০২

স্পটেড ফ্ল্যাপ-শেল টার্টল

(Spotted flap shell turtle)

লাইসেমিস পাঙ্কটাটা

(Lissemys punctata)

শুনধি কাসিম

০৩

পিকক্ সফ্ট শেল টার্টল

(Peacok soft shell turtle)

অ্যাসপিডেরেটেস হুরুম

(Aspideretes hurum)

ধুম কাসিম

০৪

এশিয়াটিক সফ্ট শেল টার্টল

(Asiatic soft shell turtle

চিত্রা ইনডেকা

(Chitra indica)

সিম কাসিম

 

বাস ও বাসস্থান: কচ্ছপের বিভিন্ন প্রজতি সাগর থেকে শুরু করে নদী-নালা, ডোবা ও স্থলে বাস করে। এদের দেহের ওজন অত্যন্ত অল্প থেকে শুরু করে কয়েকশত কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

 

             

                                                        

             

                                                         

 

প্রাকৃতিক প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ কৌশল

ডিম-ধারণ ক্ষমতা

কচ্ছপের বয়স ও আকার অনুসারে ডিম-ধারণ ক্ষমতার তারতম্য হয়ে থাকে। সাধারণত এদের ডিম ধারণ ক্ষমতা ২-২০টি পর্যন্ত হয়ে থাকে। বিশেষ এক ধরণের সামুদ্রিক কচ্ছপ ৩০০টি পর্যন্ত ডিম দিয়ে থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কচ্ছপের ডিম-ধারণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কচ্ছপ জলাশয়ের পাড়ে ডাঙ্গাঁয় এসে ডিম দেয়। ডিম দেয়ার পূর্বে স্ত্রী কচ্ছপ পিছনের পা দিয়ে নরম মাটি বা বালিতে গর্ত করে প্রতিটি গর্তে একটি করে ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার শেষ হলে সংরক্ষণের জন্য স্ত্রী কচ্ছপ মাটি দিয়ে ডিম ঢেকে রাখে। কচ্ছপের ডিম গোলাকার থেকে শুরু করে ক্যাপসুল আকারের হয়। ডিমের খোলস অত্যন্ত শক্ত এবং সাদা বর্ণের। কচ্ছপের প্রজনন সাফল্য, তথা ডিম পরিস্ফুপনের হার প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন, মাটিতে তাপমাত্রা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে । ডিম ছাড়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ভারী বৃষ্টিপাত বা অতিরিক্ত গরম বা শীতে ডিম নষ্ট হয়ে যায়।

 

পোনা উৎপাদন কৌশল

নরম খোলসধারী কচ্ছপের বৈজ্ঞানিক নাম ট্রায়নিক্স সাইনেনসিস উইজমেন( Trionyx sinenisis Weigmann ) সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় এ প্রজাতির কচ্ছপের চাষ করা হয়। এ কচ্ছপ ২-৩ বছর বয়সে ডিম দেয়। সাধারণত ২০০ বর্গমিটার বা অপেক্ষাকৃত বড় প্রজনন পুকুরে ৩:১ অনুপাতে স্ত্রী  ও পুরুষ কচ্ছপ মজুদ করে ভাল ফল পাওয়া যায়। নিরক্ষীয় অঞ্চলে এর সারা বছর ডিম দেয়। এ প্রজাতি পর্যায়ক্রমে ১০-১৫টি ডিম ছাড়ে। পুকুরের এক পাড়ে ১.৫-২.৫  বর্গমিটার স্থানে ১৫-২৫ সে.মি.পুরু বালি বিছিয়ে তার ১.০-১.২ মিটার উপরে ছাউনি দিয়ে প্রজননের স্থান তৈরি করা হয়। কচ্ছপ প্রজনন স্থানে সহজে উঠার জন্য পানি হতে প্রজননের স্থান পর্যন্ত কাঠের তৈরি ঢালু সিঁড়ি স্থাপন করা হয়।

প্রজননের স্থানে কচ্ছপের পায়ের দাগ ও গর্তের চিহ্ন দেখে প্রত্যহ সকালে বালির নীচ থেকে ডিম সংগ্রহ করে কাঠের বাক্সে ১-২ দিন রেখে দিলে নিষিক্ত ও অনিষিক্ত ডিম সনাক্ত করা যায়। নিষিক্ত ডিমের মাথায় সাদা মুকুট তৈরি হয়। অন্যদিকে অনিষিক্ত ডিমের খোলসে সাদা দাগ দেখা যায়। অতঃপর নিষিক্ত ডিমগুলোর সাদা মুকুট উপরের দিকে রেখে হ্যাচারীতে রাখা বালির স্তুপে প্রতিটি ১-২ সে.মি. দূরত্বে বসিয়ে ৫ সে.মি.পুরু বালি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ডিমের সাদা মুকুট উপরের দিকে না রাখলে ডিম ফোটার হার কমে যায়। ডিম ফোটার স্থানে সরাসরি সূর্যালোক ও বৃষ্টি পড়তে না দেয়া বাঞ্ছনীয়। সাধারণত ২৫ডিগ্রী-৬০ডিগ্রী সে. তাপমাত্রায় ৪৫-৬০দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। ডিম ফোটার স্থানের এক প্রান্তে অল্প গভীরতায় পানি রাখলে ডিম থেকে বাচ্চ বেরিয়ে গিয়ে পানিতে আশ্রয় নেয়। সদ্য প্রস্ফুটিত বাচ্চার দেহের দৈর্ঘ্য ২-৩ সে.মি. এবং ওজন ২-৪ গ্রাম হয়ে থাকে । সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় কচ্ছপের বাচ্চা লালনের কৃত্রিম খাদ্য পাওয়া যায়। কৃত্রিম খাদ্য ছাড়াও মাছ, কেচোঁ ও মুরগির মাংস খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এরা আট  সপ্তাহে ৪-৫ সে.মি. লম্বা ও ৯-১৯ গ্রাম  ওজনের হয়। এদের দৈহিক বৃদ্ধির হার পানির গুণাগুণ, মজদ ঘনত্ব এবং খাদ্যের গুণগতমানের উপর নির্ভর করে। বাচ্চার দৈহিক আকারে তারতম্য দেখা দিলে বড়গুলোকে আলাদাভাবে লালন করতে হয়। তা না হলে এদের মধ্যে স্বখাদকতা বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। বাচ্চার দৈর্ঘ্য ১০-১২ সে.মি. হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত লালন পুকুরে মজুদ রাখা হয়।

 

মজুদ পুকুরে কচ্ছপ চাষ কৌশল

উন্নত ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে মজুদ পুকুরের আকার ২০০-১০০০ বর্গমিটার এবং পানির গভীরতা ৫০-৭০ সে.মি. হওয়া বাঞ্ছনীয়। পুকুরের পাড়ে বেড়া দিয়ে কচ্ছপের বহির্গমন পথ বন্ধ করতে হয়। পুকুর শুকিয়ে তলায় চুন প্রয়োগ করে পানি সরবরাহ দিয়ে প্রতি বর্গমিটারে ৮-১২ টি পোনা মজুদ করা যায়।

 

কচ্ছপের সম্পূরক খাদ্য

কচ্ছপের খাদ্যে কম চর্বি এবং কমপক্ষে ৪৫-৫৫% প্রোটিন থাকা বাঞ্ছনীয়। ছোট মাছ, মরগির মাংস ও নাড়ী-ভুড়ি কচ্ছপের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যায়। পুকুরে প্রতিদিন এক থেকে দুবার খাদ্য সরবরাহ করতে হয়।

 

পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ ব্যবস্থাপনা

কচ্ছপ চাষের পুকুরকে তন্তুজাতীয় শেওলা ও আগাছা হতে মুক্ত রাখতে হয়। কেননা কচ্ছপ অধিকাংশ সময় পুকুরের তলায় কাদার ভিতরে বাস করে বিধায় পুকুরে জৈবিক পদার্থের পচন ক্রিয়া বেশী হলে অক্সিজেনের অভাব ঘটে কচ্ছপের ব্যাপক মৃত্যু ঘটার আশাংকা থাকে। সেজন্য পানির স্বচ্ছতা ১৫-৩০ সে.মি. রাখা বাঞ্ছনীয়।

 

কচ্ছপের উৎপাদন

বাংলাদেশে কচ্ছপ চাষের কলাকৌশল উন্নয়ন সম্পর্কিত গবেষণা এখনও তেমন পরিচালিত হয়নি। ফলে কচ্ছপের বাণিজ্যক উৎপাদন এবং মুনাফা সম্পর্কিত তথ্যাদি অত্যন্ত অপ্রতুল। উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নরম খোলসধারী কচ্ছপ চাষকালে বছরে এদের দেহের ওজন ৫০০-৬০০ গ্রাম হয়ে থাকে।

 

চাষকালীন সতর্কতা

কচ্ছপ পরিণত বয়সের পুরুষ ও স্ত্রীকে আলাদা করে রাখতে হয়। অন্যথায় পুরুষ কচ্ছপ স্ত্রীকে কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে। পুকুরে জাল টেনে বা পুকুর শুকিয়ে কচ্ছপ আহরণ করে জীবিত অবস্থায় বাজারজাত করা হয়।

 

সংরক্ষণের সুপারিশ

কচ্ছপ বাংলাদেশের জাতীয় অর্থকরী সম্পদ। পরিবেশের বিপর্যয় এবং মাত্রাতিরিক্ত আহরণের ফলে এর জীববৈচিত্র্য আজ বিলুপ্তির পথে। পরিবেশে এদের ভারসাম্যপূর্ণ মজুদ বজায় রেখে আহরণ ও চাষ পদ্ধতির উন্নয়নে দ্রূত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরী। নিম্নে এতদসংক্রান্ত কতিপয় সুপারিশ উল্লেখ করা হলো:

  1. প্রাকৃতিক পরিবেশে কচ্ছপের প্রাচুর্য্য নিরুপনের জন্য বিভিন্ন পরিবেশগত অঞ্চলে জরিপ পরিচালনা করা প্রয়োজন।
  2. কচ্ছপের যে সমস্ত প্রজাতির বাণিজ্যিক গুরুত্ব রয়েছে,সেগুলোকে সনাক্ত করে এদের প্রজনন আচরণ, খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস এবং চাষ পদ্ধতি উন্নয়ন সংক্রান্ত নিবিড় গবেষণা পরিচালনা করা প্রয়োজন।
  3. কচ্ছপের বাস ও বাসস্থানের উন্নয়নের জন্য যথাযথ বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
  4. সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় কচ্ছপের বাণিজ্যিক চাষ হয় । সে সমস্ত দেশে সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে বাংলাদেশে মৎস্য হবেষণা ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণা পরিকল্পনা প্রণয়ণ এবং বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী। এর ফলে কচ্ছপ চাষ ও  সংরক্ষণ ব্যবস্থপনা কলাকৌশল উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি তৈরী করা যাবে।
  5. বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কচ্ছপ চাষ অনেকাংশে কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদিত বাচ্চা ও সম্পূরক খাদ্যের উপর নির্ভরশীল। তাই এ চাষ ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কচ্ছপের কৃত্রিম প্রজনন, ব্যাপক পোনা উৎপাদন ও সম্পূরক খাদ্য তৈরীর কৌশল বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন।
  6. প্রাকৃতিক পরিবেশে কচ্ছপের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের নিমিত্ত জাতীয় পর্যায়ে টাস্ক ফোর্স গঠন বা এ জাতীয় অন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

 

উপসংহার

কচ্ছপ একটি বাণিজ্যিক গুরুত্বসম্পন্ন অপ্রচলিত রপ্তানী পণ্য । বিশ্ববাজারে মানুষের উপাদেয় খাদ্য হিসেবে কচ্ছপের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে বিদ্যমান কচ্ছপের বিভিন্ন প্রজাতিসমূহের মধ্যে নরম খোলসধারী কচ্ছপ চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে কচ্ছপের ভারসাম্যহীন আহরণ এবং চাষাবাদের মাধ্যমে এর উৎপাদন বৃদ্ধি করতে না পারায় দেশে কচ্ছপের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার আশাংকা দেখা দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন পরিবেশগত অঞ্চলে এর প্রাচুর্য্য নিরূপন  ও আবাসস্থলের উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এদের সংরক্ষণ করা যায়। তাছাড়া প্রণোদিত প্রজনন ও চাষ কৌশল উদ্ভাবন করে কচ্ছপের প্রাচুর্য্য বৃদ্ধি করা যায় । এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় গবেষণা পরিচালনা করা আবশ্যক । কচ্ছপের সংরক্ষণ , প্রজনন ও চাষ কার্যক্রম হাতে নেওয়ার জন্য সহায়ক পুস্তিকা হিসাবে এ ম্যানুয়েলটি প্রণয়ন করা হলো।